মূলত স্পেশাল চাইল্ডদের গল্প নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘অস্তিত্ব’। পারিবারিক অবস্থান, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সহ একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও তার পরিবারকে কি ধরনের প্রতিকূল অবস্থা পার করতে হয় তারই প্রতিফলন ‘অস্তিত্ব’। অসাধারণ একটা প্লট। মুভি না দেখে শুধু প্লটটা সম্পর্কে একটু ধারনা পেলেই যেকোন সিনেমাপ্রেমী দর্শক মুভিটা দেখতে চাইবে। কিন্তু মুভিতে চমৎকার এই প্লটটা কাজে লাগিয়ে কতটুকু সফলভাবে দর্শককের কাছে প্রেজেন্ট করা হয়েছে সেটাই প্রশ্ন। এই মুভিটা নিয়ে যদি কোন পজেটিভ কথা বলতে হয় তার প্রত্যেকবার তিশার কথা বলতে হবে, নুসরাত ইমরোজ তিশা। পারসোনালি তিশার অভিনয় খুব বেশি পছন্দ করি না, কিন্তু এই মুভিটা দেখে প্রথমবারের মত তিশার ফ্যান হলাম। একজন স্পেশাল চাইল্ডের ক্যারেক্টারে তিশা জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছে। কি কথা বলা! কি এক্সপ্রেশন! কি কস্টিউম! কি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ!
.
আরিফিন শুভ বরাবরের মতই পারফর্ম করেছেন এই মুভিতে। কিন্তু তিশার বাকরুদ্ধ করা পারফরমেন্সে শুভ’র দিকে মনোযোগই দেয়া যাচ্ছিল না। মুভিতে তিশা আর শুভ’র কস্টিউম খুবই সুন্দর ছিল। শুভ’র এন্ট্রিতে তার লুক আর কস্টিউম ছিল চোখে পড়ার মত। স্পেশাল চাইল্ডদের স্কুল টিচার হিসেবে শুভ হয়তো আরেকটু ভাল পারফর্ম করতে পারতো, কিন্তু সেটা তেমন আমলে আসেনি তিশার দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য। শুভ বা অন্য যেকেউ খারাপ ভালো যা ই করুক না কেনো মনোযোগ সব সময় তিশার দিকেই। বারবার মনে হচ্ছিল অস্তিত্ব একটা মুভি আর তিশা ও তার ক্যারেক্টারটা নিজেই আরেকটা মুভি। প্রথমার্ধে তিশার পারফরমেন্স ভোলার মত না। সাথে তিশার কস্টিউমগুলো দারুণভাবে মানিয়ে গেছে ক্যারেক্টারের সাথে, দেখতে পরী মনে হচ্ছিল (মুভিতে ক্যারেক্টারটার নামও ছিল পরী)। অস্তিত্ব যতটুকু এগিয়েছে তিশা একাই পুরোটা টেনে নিয়ে গেছে।
.
মুভির বাকি ক্যারেক্টারগুলো মোটামুটি টাইপের পারফর্ম করেছে। তিশার ভাইয়ের চরিত্রে প্রথম মুভিতেই জোভান বেশ ভাল করেছে। যদিও মুভিতে তার এমন লুক পছন্দ হয়নি কিন্তু পারফরমেন্স দিয়ে সেটা পুষিয়ে দিয়েছে। মায়ের চরিত্রে সুচরিতাকে জঘন্য লেগেছে। এই ক্যারেক্টারটা ছিল খুবই ইম্পোর্টেন্ট, চরিত্রের ইমোশনগুলো যথাযথ ফুটিয়ে তুলতে পারলে দর্শকের চোখে বারবার পানি আসতে বাধ্য ছিল। সেক্ষেত্রে সুচরিতা উনারর ওভার অ্যাক্টিং আর অদ্ভুত ভয়েস ডেলিভারী দিয়ে বারবার শুধু বিরক্তই করে গেছেন। উনার কিছু ডায়ালোগ অসাধারণ ছিল কিন্তু বাজে ডেলিভারির জন্য সেগুলোও বিরক্ত লেগেছে। সম্ভবত জোভানের বান্ধবী সৌমি আর শুভর স্কুলের টিচার চরিত্রে রুবিনা নামের দুজন নতুন অ্যাক্ট্রেস অভিনয় করেছে। দেখতে সুন্দর কিন্তু এদের পারফরমেন্সও ভাল লাগেনি, কয়েকটা দৃশ্যে এদের জামা কাপড়ও ছিল বেশ বিচ্ছিরি। সৌমি মেয়েটা তো কথা বললে মনে হয় অনেক কষ্ট করে বাংলা পড়াচ্ছে, পুরোটা সময় বুঝিয়ে বুঝিয়ে কথা বলে গেছে। তিশার বাবার চরিত্রে সুব্রত, দাদীর চরিত্রে সুজাতা আর খলচরিত্রে ডন মোটামুটি করেছে। তবে চরিত্রগুলোকে আরো ডেভলাপ করা যেত।
.
মুভিতে ছোটবড় বেশ কিছু সমস্যা ছিল যেগুলো ঠিকঠাক মত করলে অসাধারণ একটা মুভি হতো অস্তিত্ব। এটার প্লটটা যতটা অসাধারণ ছিল, চিত্রনাট্য ততটাই দুর্বল। গল্প বলায় ধীরগতি আর সামঞ্জ্যতার অভাব। মুভির সবচেয়ে খারাপ দিক বলা যায় এর এডিটিং। আরো আধা ঘন্টার আগেই শেষ করা যেত মুভিটা। ভিএফএক্সের ব্যবহার ছিল জঘন্য। ছবিতে তিশা ছাড়া বাকি কোন ক্যারেক্টারকেই ঠিকমত ডেভলাপ করা হয়নি, স্পেশালি তিশার ফ্যামিলি, হুট করে হারিয়ে গেলো। অস্তিত্বের একটা গান ছাড়া বাকি কোন গানের ব্যবহারই ঠিকভাবে হয়নি। এরকম মুভিতে হুট করে বিভিন্ন সময় রোমান্টিক গানগুলোর ব্যবহার খুবই বিরক্ত লেগেছে। যদিও সবগুলো গান আর চিত্রায়ন সুন্দর ছিল কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী মুভিতে সেগুলোর ব্যবহার ঠিক হয়নি। পুরো সিনেমায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও তেমন ভাল লাগেনি। মুভিটা বানাতে গিয়ে আরো বাজেটের দরকার ছিল বলে ডিরেক্টর নাকি তার গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছিলেন, ব্যাপারটা শুনে খারাপ লেগেছিল। মুভির প্রথমার্ধের পর মুভির ডেকোরেশন দেখে বারবার বাজেট কমে যাওয়ার কথাটাই মনে হচ্ছিল। প্রথমার্ধের অসাধারণ প্রোডাকশন ডিজাইনটা দ্বিতীয়ার্ধে বেশ মিস করেছি।
.
অস্তিত্বের পজেটিভদিক অনেক। সবচেয়ে বড় পজেটিভদিক আগেই বলেছি তিশা আর তার পারফরমেন্স। মুভির প্লটটা অনেক বেশি স্ট্রং, এমন প্লট নিয়ে কমার্শিয়াল মুভি বানানো অনেক টাফ। ডিরেক্টর হিসেবে অনন্য মামুনকে সাধুবাদ এই রিস্কটা নেয়ার জন্য। ছবিতে যে একটা গানের ব্যবহার ভাল লেগেছিল সেটা সামিনা চৌধুরীর গাওয়া মা গানটা। শুরুর দিকে প্রচন্ড ইমোশনাল একটা পরিস্থিতিতে অসাধারণ গায়কীর এই গানটা চোখে পানি এনে দেয়। মুভিতে অন্যান্য গানের ব্যবহার ভাল না লাগলেও গানগুলো শুনতে আর সেগুলোর চিত্রায়ন খুবই ভাল ছিল। সবগুলো গানই সুন্দর ছিল। “আয় না বল না” গানটা একটু বেশিই সুন্দর। অস্তিত্বের সিনেমাটগ্রাফী বেশ ভাল ছিল। মুভিটার অন্যতম পজেটিভ দিক প্রথমার্ধের প্রোডাকশন ডিজাইন আর কস্টিউম ডিজাইন। শুরু হবার পর থেকেই মুভিটা খুবই কালারফুল লাগছিল। সেটে প্রত্যেকটা জিনিস মনে হচ্ছিল খুব যত্ন করে জায়গা মত রাখা হয়েছে। তিশার বাসা, ফ্যামিলির সবাই, আর তিশাকে দেখেই যেন চোখে এক ধরনের ভাল লাগা তৈরি হয়েছিল মুভির শুরুতেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে মুভির সব পজেটিভ দিক মিলিয়ে আপনার মধ্যে যে ভাল লাগা তৈরি করবে, তিশার পারফরমেন্স একাই হয়তো তারচেয়ে বেশি ভাল লাগা তৈরি করবে। এখন পর্যন্ত দেখা তিশা বেস্ট পারফরমেন্স ছিল এই মুভিতে। সব মিলিয়ে বলা যায় মুভিটা কতটা ভাল লাগবে বা মন্দ লাগবে সেটা প্রতিটা ইন্ডিভিজ্যুয়াল দর্শকের উপর নির্ভর করেছে, তারা মুভিটা কিভাবে নিবে সেটার উপর নির্ভর করছে। তবে ডিরেক্টর এমন একটা গল্প নিয়ে কমার্শিয়াল মুভি বানানোর সাহস দেখিয়েছেন সেটা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য।
এই রিভিউটি কে লিখেছেন জানি না। আজ ছবিটি দেখে আমার রিতিমত কান্না আসছিল এইভেবে যে অন্য দেশ সবকিছুতে দিন দিন আগায়, আর আমরা দিন দিন পিছিয়ে যাই। এই ছবির চিত্রনাট্য, পরিচালনা, সবার অভিনয় এক কথায় অখাদ্য। আর তিশা ছিল কেন্দ্রীয় চরিত্রে যার অভিনয় রিতিমত হতাশাজনক। এই টাইপের ছবি দেখে টাকা এবং সময় নষ্ট না করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
ভাল লাগা আপেক্ষিক ব্যাপার। একেক জনের কাছে একেক রকম লাগবে এটাই স্বাভাবিক। তবে মুভিটা আরো অনেক ভাল হতে পারতো…