আমাদের গর্ব করার মত যে কয়টি জিনিস আছে তার মধ্যে সর্বাগ্রে থাকবে মহান মুক্তিযুদ্ধ। এর মধ্য দিয়েই আমাদের একটি দেশ পাওয়া,লাল সবুজের একটি পতাকা পাওয়া।ত্রিশ লক্ষ শহিদ এবং আড়াই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতার পিছনে লুকিয়ে হাজারো না বলা গল্প।যা দিয়ে নির্মিত হতে পারে অনেক ভালো ভালো সিনেমা।যুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত সিনেমার সংখ্যা খুব বেশি নয় এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটা সিনেমা বাদ দিলে বেশির ভাগই কমন প্লটের উপর নির্মিত। যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে এখনো নির্মিত হচ্ছে নানা রকমের সিনেমা।
আমরা যারা হলিউডের বিগ বিগ বাজেটের নানা যুদ্ধের সিনেমা দেখিয়ে চোখ পাকিয়ে ফেলেছি তারা যদি এখন সেই একই স্বাদ পাবার আসায় ভুবন মাঝি দেখার জন্য সিনেমা হলে ঢু মারেন,তাহলে ভুল করবেন।যুদ্ধের সিনেমা মানেই শুধু যুদ্ধ এবং এর ব্যাপকতা দেখানো নয় এর বাইরেও দেখানোর অনেক কিছু আছে।যেমনটি দেখেছিলাম লাইফ ইজ বিউটিফুল সিনেমাতে।
যাই হোক যখন শুনলাম ভুবন মাঝি সিনেমাটি কুষ্টিয়ার একজন বাউলের মুক্তিযুদ্ধকালীন জীবনকে উপজীব্য করে বানানো তখন থেকেই আগ্রহ জন্মেছিল।
আমাদের দেশে নন লিনিয়ার সিনেমা হয়েছে কিনা জানা নাই,তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে হয় নাই এইটা শিওর।মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়কে বর্তমান সময়ের সাথে কো রিলেট করা খুব সোজা কাজ নয়,কঠিন একটা কাজ।সেই কঠিন কাজটিই করেছেন পরিচালক,এই জন্য পরিচালকের অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য।তবে গল্পের গাঁথুনি যদি আরো মজবুত হত তবে তাকে টুপিখোলা সম্মানই জানাতাম।
পরিচালক তিনটি সময়কে ধরেছেন,১৯৭১,২০০৪ এবং ২০১৩।তিনটি সময়কে সিনেমায় দেখানো এবং একই সুতায় গাথা একটু বেশি কঠিন কাজ।এই কঠিন কাজটি করতে গিয়ে তিনি যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে পারেন নাই।
যুদ্ধের সিনেমাতে বাজেট একটি বড় বিষয়।তার উপর যেহেতু সরকারি অনুদানে নির্মিত তাই বাজেটের বিষয়ে না হয় ছাড় দিলাম,সেই জন্য পরিচালকের উচিত ছিল চিত্রনাট্যের উপর আরেকটু জোর দেয়া,তাহলে আমরা একটি জমজমাট যুদ্ধের সিনেমা পেতে পারতাম।
নহির বাউল এবং তার প্রেয়সী ফরিদাকে কেন্দ্র করেই সিনেমার কাহিনী আবর্তিত হয়েছে।নহির সংস্কৃতি সচেতন অপরদিকে ফরিদা রাজনীতি সচেতন।নহির ধারণ করে লালন, রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল।তার জন্য যুদ্ধ খুব সুখকর নয়, তার উপর মানুষ হত্যা আরো কঠিন কাজ।পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা সময়ে এই ধরণের মানুষগুলো অস্তিত্ব বিরাজমান,যেমনটা দেখা যায় হ্যাকশ রিজে ডেসমণ্ড ডস এর ক্ষেত্রে(এন্ড্রু গ্যারিফিল্ড)।কিন্তু যুদ্ধের নির্মমতা মানুষকে বাধ্য করে নিষ্ঠুর হতে।
যারা আমাদের দেশটি চায়নি,পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সেই সকল এই দেশীয় দোসররা যে আজও আমাদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে,এই দেশের বিরুদ্ধে তারই যৌক্তিক উপস্থাপন দেখা যায়।বাউলদের উপর অত্যাচার,যুদ্ধাপরাধীর বিচার সবই উঠে এসেছে সিনেমাটিতে।
একটি আধুনিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার খুবই জরুরি, তারা এবং তাদের এই সময়ের দোসররা যে এখনো আমাদের দেশ, সংস্কৃতিটাকে মেনে নিতে পারে নাই, সুযোগ পেলেই আমাদের সংস্কতিমূলে আঘাত হানতে উদ্যত হয়,তার প্রমাণ তো আমরা হর হামেশাই দেখতে পাচ্ছি।
পরমব্রত তো বরাবরই ভালো অভিনেতা তার সাক্ষর তো উনি রেখেছন।এই সিনেমাতেও তার বেত্যয় ঘটেনি।নহিরের ভেতর যে আত্নিক দ্বন্দ তা খুবই সুন্দর এবং বাস্তব সম্মত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।কিছু কিছু সংলাপ এবং এক্সপ্রেশন দেখে মনে হয়েছে এসবের জন্য পরমব্রতই পারফেক্ট। আর বর্তমান সময়ের অভিনেত্রীদের মধ্যে অপর্ণা ঘোষ যে কেন ব্যাতিক্রম তার প্রমাণ আরেক বার দিলেন। তার সহজ সাবলীল অভিনয় ছিল মনে রাখার মত।তার চেহারায় আমি তেমন কোন গ্ল্যামার খুজে পাই না,কিন্তু রয়েছে এক অন্য রকম মাদকতা,সেই সাথে ইউনিক ভয়েস টন,যা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য!!!
এইছাড়া মাজনুন মিজান ও খুব ভালো অভিনয় করেছেন।এইছাড়া বাকি সবাই যে যার চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করেছেন।অতি অভিনয় ছিল না কারোরই।
এই সিনেমার প্রাণ বলা চলে এর লোকেশন,সিনেমাটোগ্রাফি এবং গান।প্রত্যেকক্ষেত্রেই যত্নের ছাপ ছিল সুস্পষ্ট।
রেললাইনের উপর বসে নহির আর ফরিদার কথোপকথন এবং গড়াই নদীর তীরে বসে নহিরের ফরিদার কানে দুল পড়িয়ে দেয়ার দৃশ্যদুটি অনেকদিন হৃদয়ে গেঁথে থাকবে।💜
💜
আর গান গুলার কথা বললে সবগুলা গানই ভালো লেগেছে এর মধ্যে আমি তোমারই নাম গাই তো মনে হয় বাংলা সিনেমার কালজয়ী গানের তালিকায় ঢুকে যাবে!!
“অনেক দিন পর মনে হচ্ছে এই দেশ আমার এই পতাকা আমার,যেমনটি তুমি আমার ”
এই দেশ, এই পতাকার প্রতি আমাদের প্রেম থাকুক চির জাগরুক।
জয় বাংলা! জয় হোক বাংলা চলচ্চিত্রের 💜
💜
💜
বি.দ্র. এই সিনেমাটি আমাদের বয়সের মানুষের না দেখলেও চলে,কিন্তু উঠতি বয়সের যে সব কিশোর -কিশোরী, তরূণ-তরূণী আছে তাদের অবশ্যই দেখা উচিত।কারণ ওই বয়সটাই হচ্ছে দেশের ইতিহাস,সংস্কতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভের উপযুক্ত সময়।